১৩ বছর আগে চার শব্দের গ্রাফিতিতে সিরিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল এক কিশোর
গাজীপুর টাইমসঃ সীমাহীন দুর্নীতি, বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০১০ সালের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আরবে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। শুরুটা হয় তিউনিসিয়ায়। এরপর তা আরব বসন্ত হয়ে লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইনে ছড়িয়ে পড়ে। তিউনিসিয়ায় ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক বেন আলীর বিরুদ্ধে শুরু হয় জনতার সংগ্রাম। ২৮ দিনের টানা আন্দোলনে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁর ২৪ বছরের শাসনের পতন হয়। একই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনের জনতা প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর পদত্যাগের ডাক দেয়। এর এক বছর পর ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ২২ বছরের টানা ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ মিসরের তাহরির স্কয়ারে স্মরণকালের বড় সমাবেশ ঘটে। সেদিনই টানা ৩০ বছরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন ঘটান জনতা। এ সময় লিবিয়াতেও আরব বসন্তের ছোঁয়া লাগে। বিপ্লব সেখানে সহিংস গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। ২০ অক্টোবর বিদ্রোহীদের হাতে মোয়াম্মার গাদ্দাফির নির্মম মৃত্যু হয়। গাদ্দাফি ছিলেন লিবিয়ার ৪২ বছরের দুর্দান্ত প্রতাপশালী এক শাসক।
সেই দিনগুলোতে টেলিভিশন খুললেই দেখা যেত আরব অঞ্চলের এসব আন্দোলন ও শাসকদের পতনের খবরাখবর। এগুলো দেখে দেশে দেশে নিষ্ঠুর শাসনে নিষ্পেষিত মানুষের সাহস বাড়ছিল। বিশেষত আরব দেশগুলোতে। মানুষ কথা বলার সাহস পাচ্ছিল। শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ—সবার মধ্যে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছিল। তেমনই স্কুলপড়ুয়া একদল শিশু, যাদের প্রতিদিনের কাজ ছিল সকালবেলা উঠে হোমওয়ার্ক করা, স্কুলে যাওয়া আর খেলাধুলা করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা—স্বৈরশাসক হটানোর এই উচ্ছ্বাস তাদেরও স্পর্শ করে। একদিন নিজেদেরই স্কুলের কাছের একটি পুলিশ স্টেশনে হয়রানির শিকার হয় তারা। ক্ষোভে আক্রান্ত এই শিশুরা সিদ্ধান্ত নেয় কিছু একটা করার।
২০১১ সাল, দক্ষিণ সিরিয়ার দারা শহরের মুয়াবিয়ার বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। বন্ধুদের নিয়ে ছুটে বেড়াতেন শহরের অলিতে-গলিতে। এই কিশোরের এক বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড যেন লিখে দিল সিরিয়ার ভবিষ্যৎ। ১৩ বছর আগে মুয়াবিয়া একদিন সিরিয়ার রাজপথে দেয়ালে দেয়ালে স্প্রে-পেইন্ট দিয়ে গ্রাফিতি আঁকলেন, যাতে লেখা—‘এজাক এল ডোর, ইয়া ডাক্তার’ অর্থাৎ ‘এখন তোমার পালা, চিকিৎসক।’এ গ্রাফিতি ছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ইঙ্গিত করে, যিনি এককালে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এরপরেই সিরিয়ায় শুরু হয় এক বিদ্রোহের, যা একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। মুয়াবিয়া ও তাঁর বন্ধুরা স্থানীয় পুলিশের হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। সেই ক্ষোভ থেকে তাঁরা এই প্রতিবাদ করেছিলেন, যা জনসম্মুখে নিয়ে এসেছিল বাশার আল-আসাদ সরকারের আসল চিত্র। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে জমে থাকা ক্ষোভ।
এই ঘটনার পর মুয়াবিয়া ও তাঁর বন্ধুদের ২৬ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে মুকহাবারাত। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের হাতিয়ার ছিল গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তৈরি নেটওয়ার্ক মুকহাবারাত। এ ঘটনায় দারার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। মুয়াবিয়াদের মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন অভিভাবক, প্রতিবেশীসহ দারা শহরের হাজার হাজার মানুষ। মুখোমুখি হয় টিয়ার গ্যাস ও গুলির। নির্যাতনে জখম ছেলেদের ছবি ছড়িয়ে পড়লে এই ঘটনা একটি প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। দারা শহর থেকে পুরো সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।
২০১১ সালের ১৫ মার্চ প্রথমবারের মতো সিরিয়ায় সমন্বিত ‘ডে অব রেজ’ বা ‘ক্ষোভের দিন’ পালিত হয়। স্থানীয় অসন্তোষ পরিণত হয় জাতীয় আন্দোলনে। লক্ষ্য আসাদ সরকারের পতন ও স্বাধীনতা। আন্দোলন দমাতে শুরু হয় নির্মম ও লাগাতার দমন-পীড়ন। নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়, ভিন্নমতাবলম্বীদের কারাগারে নিক্ষেপ করে। অসংখ্য সিরিয়াবাসী নির্যাতনের শিকার হয়। বিদ্রোহীরা অস্ত্র হাতে তুলে নিলে আরব বসন্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত এই আন্দোলন দ্রুতই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়।
২০১১ সালের জুলাই মাসে আসাদের সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদের নিয়ে গঠিত হয় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)। তবে এটি একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা, বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে পরে জাবহাত আল-নুসরা, আইএসের মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের শক্তিশালী করে তোলে।
সেই গ্রাফিতির ঘটনার ১৩ বছর পর, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পতন হয়েছে। পতন হয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের। আল-আসাদ একটি উড়োজাহাজে করে দামেস্ক ছেড়ে অজানা গন্তব্যে চলে গেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় অবসান হয়েছে আল-আসাদ পরিবারের প্রায় ৫৪ বছরের শাসনের।