শহীদ ভাষা সৈনিকদের আদর্শকে বুকে ধারণ করা এক খ্যাতিমান কবির নাম আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

গাজীপুর টাইমসঃ ৫২তে রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষার্থে ঘাতকদের বুলেটের সামনে বুক চেতিয়ে দাড়িয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে পুরো শহর মুখরিত করেছিলো এদেশের কিছু সূর্য সন্তান। একটি ভাষার জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে আগের রহস্যের জাল ছিন্ন করে দৈনিক আজাদ। এদিন সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ প্রকাশ করে বিশেষ টেলিগ্রাম। ব্যানার হেডলাইন করা হয়, ‘ছাত্রদের তাঁজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’।

শহীদ ভাষা সৈনিকদের আদর্শকে বুকে ধারণ করা এক খ্যাতিমান কবির নাম আবু হেনা মোস্তফা কামাল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের শক্তিমান এই কবির বর্ণাঢ্য ও বহুবর্ণিল কবিজীবন নিয়েই আজকের এই লেখা।

মাত্র তিনটি কবিতাগ্রন্থের প্রণেতা হয়েও কবিতার মাঠে তিনি ছিলেন শক্তিশালী অবস্থানে। ১৯৩৬ সালের ১৩ই মার্চ পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক ও ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন।
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ত্রয়োদশ স্থান এবং আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এত ভালো ফল করার পরেও বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা থাকায় তিনি তথাকথিত কোন ভালো বিষয়ে না পড়ে বাংলাকে বেছে নিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮-তে বাংলায় বিএ অনার্স এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯-এ বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক(সম্মান) ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।
ব্যক্তিজীবনে খুব ছোট থেকেই আবু হেনা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী। নিয়মিত লিখতেন কবিতা আর গান। স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, হৃদয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতি, গভীর আবেগ সব মিলিয়ে আধুনিক শিল্প চর্চার এক পরিশিলিত রূপের দেখা মেলে তার কবিতা আর গানে।

তার প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থগুলো হলো,
আপন যৌবন বৈরী, যেহেতু জন্মান্ধ, আক্রান্ত গজল।

আপন যৌবন বৈরী’র একটি কবিতার শিরোনাম ‘কবি’। কবিতাটিতে একজন প্রকৃত কবির স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন একজন কবির কবিতা সৃষ্টির কী মর্মান্তিক কাতরতা। জীবনের কতটুকু ব্যয় করে একজন কবি শব্দমালা তুলে আনেন কলমের নিবে; কতটুকু দুঃখ হজম করে কিনে আনেন একেকটি কবিতার প্লট। একেকটি কবিতার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে থাকে কবির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালোবাসা-ঘৃণা। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল এই কবিতায় ঈশ্বরকেও কবির খাতায় নাম লিখিয়েছেন; তবে ঈশ্বর সৌখিন কবি, সুখের কবি, সুন্দরের কবি। কিন্তু একজন মানুষ যখন কবি হয়ে ওঠেন; তখন তাকে জীবনের দুঃখ জেনে, অন্ধকার অলি-গলি চিনে এসে কবি হতে হয়; তার চলার পথ থাকে কণ্টকে ভরা।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল একাধারে বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একজন স্বার্থক শিক্ষক, সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গীতিকার, কবি, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও জনপ্রিয় উপস্থাপক। জীবনের প্রথম দিকে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার রেডিও, টেলিভিশনের একজন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী।

‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে’, ‘নদীর মাঝি বলে’, ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা’,‘এই বাংলার হিজল তমালে’র মত জনপ্রিয় গানের গীতিকার ছিলেন তিনি।

‘অনেক বৃষ্টি ঝরে’ গানটি লেখার নেপথ্যে একটি কাহিণী জড়িয়ে আছে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের সন্তান হচ্ছিলো না। অনেক অপেক্ষার পরে যেদিন তার বড় মেয়ে জন্ম নেন সেদিন সারাদিন তুমুল বৃষ্টি হয়। মেয়ে জন্ম নেয়ার পর সেদিনই তিনি তুমুল জনপ্রিয় এই গানটি লিখে ফেলেন।
অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে
যেন এক মুঠো রোদ্দুর
আমার দুচোখ ভরে
তুমি এলে….

তিনি শিক্ষকতা জীবনের শুরুতেই অত্যন্ত অল্প বয়সে পিএইচডি করেন কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, শিক্ষকতা জীবনেও সমান মেধার পরিচয় দিয়েছেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে নিয়োগ পান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে যখন উনি বাংলা বিভাগের ক্লাস নিতেন, তখন ক্লাসের পেছন দিকে এবং ব্যালকনিতে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য বর্ষের বা সেকশনের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে স্যারের বক্তৃতা শুনত, মনে হতো এটা কোনো জনসভা।

কর্মজীবনের প্রথমে কলেজের অধ্যাপনা দিয়ে শুরু করেছিলেন। বেশ ক’টি কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন; এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা জীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিনি।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে মহাপরিচালক পদে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে যান ১৯৮৬ তে। আমৃত্য তিনি এই বাংলা একাডেমিতেই ছিলেন। ধারণাতীত যে, মাত্র বায়ান্ন বছরের জীবনে একজন মানুষ কত জায়গায় পদচিহ্ন রেখে গেলেন!

গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের (মাঝখানে) সঙ্গে আবু হেনা মোস্তফা কামাল (ডানে), ছবি: সংগৃহীত

আবু হেনা মোস্তফা কামালের অর্জনের তালিকাও নেহাৎ কম নয়। আলাওল সাহিত্য পুরষ্কার, সুহৃদ সাহিত্য স্বর্ণপদক, একুশে পদক, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক সহ সা’দত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরষ্কার রয়েছে তার ঝুড়িতে।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম হয়েছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবার জন্য; একজীবনে তিনি সেবা দিয়ে গেছেন। জীবৎকালে তিনি যেখানেই থেকেছেন, যেভাবেই থেকেছেন বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছেন। তাঁর চিন্তা-চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষ তাই তাঁর কাছে বিশেষ ঋণী; যে ঋণ কখনও পরিশোধযোগ্য নয়।
খ্যাতিমান এই মানুষটি ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আসিফ হোসাইন
লেখক ও কলামিস্ট

Share your love